শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৯:২৬ অপরাহ্ন
: আফতাব চৌধুরী:
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত ঋষি। বছর বিয়াল্লিশের তিনিই ব্রিটেনের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী যদিও ব্রিটেনের রাজনীতিতে ঋষি অনেক বড় নাম। কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য ঋষি আগে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রীও ছিলেন। জানা গেছে, এবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ঋষি ব্রিটেনের পার্লামেন্টের ১৯১ সদস্যের সমর্থন পেয়েছেন।
১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ বাসিন্দা ৪২ বছরের ঋষি সুনাককে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীও তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। টুইটারে তিনি লেখেন, ‘২০৩০ সালের কথা মাথায় রেখে তৈরি রোডম্যাপ মেনে আপনার সঙ্গে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ে কাজ করার অপেক্ষায় রইলাম। ব্রিটেনবাসী ভারতীয়দের ‘জীবন্ত সেতু’র জন্য দীপাবলির বিশেষ শুভেচ্ছা। আমরা দু’দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে আধুনিক অংশীদারির রূপ দিতে পারব।’
এবার দেখার বিষয় হলো, সা¤প্রতিককালে অর্থনৈতিক সঙ্কটের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্তরেও কার্যত ডামাডোলের মধ্যে থাকা ব্রিটেনকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যান ঋষি। এবার ঋষির সঙ্গে শেষ অবধি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন পোর্টমাউথ নর্থের এমপি পেনি মরডন্টও। তবে ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পর মরডন্টও প্রধানমন্ত্রীর দৌড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলে সমর্থন ঋষির পক্ষে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রীর পদ নিশ্চিত, হওয়ার পর ঋষি ব্রিটেনের অর্থনীতিকে আবার চাঙা করার কথা বলেন। পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নাম নিশ্চিত হওয়ার পর দেওয়া ভাষণে ঋষি ব্রিটেনের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির কথা বলেন। তিনি খুব সুন্দর করে বলেন, আজকের পড়ুয়ারা আগামীর অর্থনীতির কারিগর।
খুব সুন্দর কথা বলেন তিনি। আজ আমাদের দেশ, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেমন ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স এদের থেকে পিছিয়ে থাকার একমাত্র কারণই হলে খারাপ শিক্ষাব্যবস্থা বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার যেন সংস্কারই হচ্ছে না। সরকারের তরফে নতুন শিক্ষানীতি বলবৎ করার কথা যদিও বলা হচ্ছে কিন্তু তা কবে যে পুরোপুরি বলবৎ হবে এবং আদৌ হবে কিনা, তা কেউই জানেন না। তাছাড়া, বাংলাদেশের মত দেশে সরকার চাইলেই যে নিজেদের ইচ্ছেমতো তারা সব জায়গায় নতুন শিক্ষানীতি বলবং করতে পারবে, এমনটা মনেই হয় না। কারণ, যতটুকু এই নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির ব্যাপারে জানা গেছে এবং বিশেষজ্ঞের মত হলো, ভালই হবে এটা পুরোপুরি বলবৎ হলে। কিন্তু দেশের বর্তমান যে হাল অবস্থা তাতে জাতীয় শিক্ষানীতি বলবৎ করা অনেক কষ্টের ব্যাপার। যতদিন পর্যন্ত না দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো হচ্ছে, ততদিন দেশের প্রগতি অসম্ভব।
সে যা-ই হোক ঋষিই যে একমাত্র ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত, যিনি বিদেশের রাজনীতিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছেন বা বর্তমানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ব্যাপারটা এমন নয়। ২০২১-র গোড়ার আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেত্রী কমলা হ্যারিস। ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ এবং প্রেসিডেন্ট পৃথ্বীরাজ রুপুন দু’জনই ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত। ২০১৫ সাল থেকে পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা অ্যান্টোনিওর প‚র্বপুরুষরা ছিলেন পর্তুগিজ উপনিবেশ গোয়ার মানুষ।
দক্ষিণ আমেরিকার ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র সুরিনামে ২০২০ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত চন্দ্রিকা প্রসাদ সান্তোখি। দক্ষিণ আফ্রিকার আর এক দেশ গায়ানার প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত ৪২ বছরের মহাম্মদ ইরফান আলি।
অন্যদিকে, ব্রিটেনের রাজনীতিতে কয়েক বছর ধরেই চর্চায় রয়েছেন ঋষি সুনাক ইনফোসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণম‚র্তির জামাইকে ঘিরে বিতর্কও হয়েছে বিস্তর। যে-সব ব্যক্তি ব্রিটেনের বাইরের বাসিন্দা কিন্তু পেশা স‚ত্রে ব্রিটেনে রয়েছেন, তাঁদের সে-দেশের সরকারকে একটি বিশেষ কর দিতে হয়। ‘প্রভাব খাটিয়ে’ সেই কর ফাঁকির অভিযোগ বারবার ওঠে ঋষি-পতœী অক্ষতার বিরুদ্ধে।
১৯৮০ সালের ১২ই মে সাউদাম্পটনে ঋষির জন্ম। আফ্রিকান পাঞ্জাবি পরিবারে বেড়ে ওঠা তাঁর। হ্যাম্পশায়ার ও উইনচেস্টার কলেজে স্কুলজীবন শেষে অক্সফোর্ডের লিঙ্কন কলেজ থেকে ২০০১ সালে স্নাতক হন তিনি। পরে ২০০৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড পড়াশোনা করেন ঋষি। ২০১৪ সালে রাজনীতিতে পা রাখেন। সে-বছর রিচমন্ড থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ নিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির হয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। ব্রিটেনের বিত্তবানদের মধ্যে অন্যতম ঋষি। তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ জানলে চোখ কপালে উঠবে! সংবাদ সংস্থা স‚ত্রে খবর, ঋষি ও তাঁর স্ত্রীর অক্ষতার মোট সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৭৩০ মিলিয়ন পাউন্ড। বাংলাদেশীয় মুদ্রায় ৭০০০ কোটি টাকারও বেশি। মোটের উপর অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং বিত্তবান একজন ব্যক্তি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী গদিতে বসছেন। তাই তাঁর ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত হওয়া নিয়ে ভারতে কিছু মানুষ আসলে বিভ্রান্তির সাগরে বাস করছেন। কবি সুনাক ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত, আর ভাই এর থেকে ভারতের কোনও ফায়দা হবে বা ব্রিটেনের সঙ্গে ভারতের ব্যবসা-ট্যাবসা বাড়বে, এমন যারা ভাবছেন তাদের ধারনাও ভুল। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের জড় তো সরাসরিই ভারতের সঙ্গে রয়েছে। তাঁর মায়ের তো ভারতেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। গত এক বছরে কমলা হ্যারিসের কাছ থেকে ভারত আলাদা করে কি সাহায্য পেয়েছে? আর কবি সুনাক তো এমন এক ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত, যাঁর জড় সরাসরি ভারতের সঙ্গে নেই। তাঁর প‚র্বসুরিরা ভারত থেকে- চলে যান অনেক আগে। তাঁর পতœী শ্বশুর হয়তো ভারতীয়। কিন্তু ইনফোসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণম‚র্তির জামাই হওয়ায় ভারতের আলাদা কোনও লাভ হবে না, তা হলফ করে বলা যায়।
না, কোনও নেগেটিভ বিষয় এখানে তুলে ধরা হচ্ছে না। কিন্তু ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত ঋষি সুনাকের ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিশ্চিত হওয়ায় ভারতের ইলেকট্রনিক মিডিয়া জগৎ যেভাবে এ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছে, তাতে মনে হয় সাধে কি আর এদের বিশ্বের মধ্যে ১৪০- পরে স্থান দেওয়া হয়েছে ? তারা দেশের জনতার কথা তুলে ধরতে চায় না। তারা চায় শুধু টিআরপি। আর তাই দেশ- বিদেশের রাজনীতি ছাড়া আর কোনও খবর পরিবেশন করবে না।
সে যা-ই হোক, ঋষি সুনাক আবার ব্রিটেনের [অর্থনীতিকে সঠিক জায়গায় নিয়ে আসবেন, এই আশা করা যায় আর যা খুব গুরুত্বপ‚র্ণও বটে। কারণ, ছয়-সাত মাস ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়েছে। বিশ্বের সর্বত্রই আর্থিক মন্দার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আর তাই শুধুমাত্র ব্রিটেন কেন, সারা বিশ্বই আবার ঘুরে দাঁড়াবে, এই আশা নিয়ে নিবন্ধের ইতি টানছি। সঙ্গে এ-ও লিখছি, অর্থনীতির খারাপ গতির চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। এটা মাথায় রেখে চলা উচিত। সাংবাদিক-কলামিস্ট। ২৬.২.২০২৩